Uncategorized

হিজরত: রাসুল (সা) এবং সাহাবীদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের কাহিনী।

ভূমিকা

ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে মক্কার মুসলিমরা নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ত্যাগ, কঠোরতা এবং ন্যায়ের পথে অবিচলতা ছিল এই সময়ের বৈশিষ্ট্য। প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় ইসলামের প্রচার চলছিল গোপনে, কারণ প্রকাশ্যে তা প্রচার করা মক্কার অবিশ্বাসীদের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিল। হিজরত সেই সময়ের একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল, যা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

মক্কায় ইসলামের সূচনা এবং প্রাথমিক প্রতিকূলতা

ইসলামের সূচনা

মুহাম্মদ (সা.) প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। তিন বছর ধরে তিনি শুধুমাত্র তাঁর নিকট আত্মীয়দের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেন। এরপর, আল্লাহর নির্দেশে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং লোকদের এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনার জন্য আহ্বান জানান। ইসলাম প্রচারের মূল বিষয় ছিল আল্লাহর একত্ববাদ, ন্যায়বিচার, মানবিকতা, এবং সামাজিক সমতা।

প্রাথমিক প্রতিকূলতা

মক্কার নেতৃস্থানীয়রা ইসলামের এই নতুন বার্তা সহজভাবে মেনে নেননি। ইসলাম প্রচারের ফলে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক কাঠামো, এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ হুমকির মুখে পড়ে। কারণ, মক্কার কুরাইশ নেতারা মূর্তি পূজার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন। কাবা ঘরে বিভিন্ন মূর্তির পূজা হতো, যা দূরদূরান্ত থেকে পূণ্যার্থীদের মক্কায় টেনে আনত এবং তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করত।

ইসলামের প্রাথমিক অনুসারীরা মক্কার নেতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকারের নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতন এবং প্রতিকূলতার কিছু প্রধান দিক ছিল:

  1. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট: ইসলামের প্রথমদিকের অনুসারীরা বেশিরভাগই দরিদ্র, দাস এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ ছিলেন। কুরাইশরা তাদের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যাতে তাদের জীবিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা ইসলাম পরিত্যাগে বাধ্য হয়। তিন বছর ধরে নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীরা শিবে আবু তালিব নামক একটি স্থানে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ অবস্থায় জীবনযাপন করেন।

  2. শারীরিক নির্যাতন: অনেক মুসলমানদের উপর শারীরিক অত্যাচার চালানো হতো। যেমন, প্রখ্যাত সাহাবী বিলাল (রা.)-কে মরুভূমির প্রখর রোদে তপ্ত পাথরের উপর ফেলে নির্যাতন করা হতো। একইভাবে, ইয়াসির পরিবারকেও নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়।

  3. হুমকি এবং মিথ্যা অভিযোগ: নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হতো, যেমন তিনি মিথ্যা বলছেন বা যাদু করছেন। এছাড়া তাঁর অনুসারীদেরও বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা করা হতো।

  4. প্রবাসী হয়ে মদিনায় হিজরত: মক্কার প্রতিকূল পরিবেশের কারণে অনেক মুসলমানকে শেষপর্যন্ত মদিনায় হিজরত করতে হয়। মদিনায় তারা একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান এবং ইসলামের প্রচার আরো বেগবান হয়।

ইসলামের জন্য মক্কার প্রতিকূলতার শিক্ষা

মক্কার এই প্রতিকূলতা ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। প্রতিকূলতার মধ্যেও ধৈর্য, সহনশীলতা এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইসলামের মূল বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত এটি স্থাপন করে। মক্কার এই প্রতিকূল সময়কাল ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলে এবং পরবর্তীতে ইসলামের প্রসারের পথ সুগম করে।

মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিমদের উপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছিল, তা ছিল তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও নৈতিকতার পরীক্ষা এবং ইসলামের দৃঢ়তাকে প্রমাণিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কায় আল্লাহর একত্ববাদ এবং মানবতার নীতি প্রচার শুরু করেন, তখন মক্কার কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ইসলামকে তাদের প্রথাগত ধর্ম ও সমাজ কাঠামোর জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিল।

১. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট

কুরাইশ নেতারা মুসলিমদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে তাদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তারা একটি চুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে কেউ মুসলিমদের সাথে বিয়ে করবে না, বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না, এমনকি তাদের সাথে কোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্কও রাখবে না। ফলে মুসলমানদের জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে ওঠে, এবং তাঁরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হন। তিন বছরের জন্য, মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীরা শিবে আবু তালিব নামক স্থানে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন।

২. শারীরিক নির্যাতন

কুরাইশ নেতারা বিভিন্ন সাহাবীদের উপর অত্যন্ত নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালায়, যাতে তারা ইসলাম ত্যাগে বাধ্য হয়। কিছু উদাহরণ হলো:

  • বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.): আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এই দাস সাহাবীকে প্রখর রোদে মরুভূমির উত্তপ্ত পাথরের উপর ফেলে নির্যাতন করা হতো এবং তার বুকে ভারী পাথর রেখে চাপ দিয়ে বলা হতো যে ইসলাম ত্যাগ করতে। তবে, তিনি দৃঢ়ভাবে “আহাদ, আহাদ” (এক আল্লাহ, এক আল্লাহ) বলে ধৈর্য ধারণ করতেন।

  • ইয়াসির পরিবার: আম্মার ইবনে ইয়াসিরের (রা.) পিতা ইয়াসির (রা.) এবং মাতা সুমাইয়া (রা.) ছিলেন প্রথম শহীদ, যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সুমাইয়া (রা.)-কে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল কারণ তিনি ইসলাম ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছিলেন।

  • খাব্বাব ইবনে আরাত (রা.): তাকে উত্তপ্ত লোহার উপর শুইয়ে নির্যাতন করা হতো। তার শরীর পুড়ে গেলেও তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি।

৩. মানসিক নির্যাতন ও অপবাদ

মক্কার কুরাইশরা নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে মিথ্যাবাদী, কবি, যাদুকর এবং পাগল হিসেবে অপবাদ দিতেন। তারা জনগণের মধ্যে এই ধারণা ছড়াতে চেয়েছিল যে মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন। এভাবে তারা মুসলিমদের মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল।

৪. হত্যার ষড়যন্ত্র

মুসলিমদের উপর নির্যাতন কেবল তাদের মানসিক ও শারীরিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না; কুরাইশ নেতারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনাও করেছিল। তাঁদের মতে, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুই ইসলামের প্রসার বন্ধ করার একমাত্র উপায়। তবে আল্লাহর নির্দেশে নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করে।

৫. মদিনায় হিজরত এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি

মুসলমানদের ওপর মক্কায় নির্যাতন এমন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল যে তাঁদের জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সময় আল্লাহর আদেশে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তাঁরা মুক্ত পরিবেশে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ এবং প্রচার করতে সক্ষম হন। তবে মক্কার কুরাইশরা এই হিজরত মেনে নিতে পারেনি এবং ইসলাম ধ্বংস করতে তারা মদিনায় আক্রমণ চালাতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটেই মুসলিমরা প্রতিরোধের অনুমতি লাভ করে এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

মুসলিমদের উপর অত্যাচারের শিক্ষা ও প্রভাব

এই নির্যাতন ও প্রতিকূলতা ইসলামের প্রাথমিক অনুসারীদের সাহস, ধৈর্য, এবং বিশ্বাসের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে। তাদের উপর আরোপিত অত্যাচার তাদের ঈমানকে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং তাদেরকে ইসলামের প্রচারে আরও একনিষ্ঠ ও সংহত করে তোলে। ইসলামের ইতিহাসে এই প্রাথমিক প্রতিকূলতা প্রমাণ করে যে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে গেলে অনেক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়, তবে দৃঢ় বিশ্বাস, সাহস ও ধৈর্যের মাধ্যমে সব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।

মুসলিমদের উপর এই নির্যাতন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষার স্তম্ভ হয়ে আছে, যা বলে দেয় যে বিশ্বাসের জন্য সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন, এবং ইসলামের এই ইতিহাস মানুষকে তার ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি অটল থাকতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

ইসলামের দিকে মদিনার দাওয়াত এবং আউস ও খাজরাজের ইমান গ্রহণ

১. মদিনায় দাওয়াতের সূচনা

মক্কায় কুরাইশদের প্রতিকূলতা এবং মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকায় নবী (সা.) অন্যান্য শহরের মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার চিন্তা করেন। বিশেষত, প্রতিবছর হজের মৌসুমে আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন মক্কায় আসত, যা ইসলামের বার্তা প্রচারের জন্য একটি উপযুক্ত সময় হিসেবে কাজ করত। নবী (সা.) এই সুযোগে বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে শুরু করেন।

২. আউস ও খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ

৬২০ খ্রিস্টাব্দে, হজের মৌসুমে মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের একটি ছোট দল মক্কায় আসে এবং তারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করে। নবী (সা.) তাদের সাথে কথা বলে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করেন এবং এক আল্লাহর ইবাদতের আহ্বান জানান। মদিনার মানুষগুলো দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। ইসলাম তাদেরকে ঐক্য ও শান্তির বার্তা দিল, যা তাদের জন্য আকর্ষণীয় ছিল।

৩. প্রথম আকাবার সন্ধি

৬২১ খ্রিস্টাব্দে, আউস ও খাজরাজ গোত্রের ১২ জন প্রতিনিধি আবার মক্কায় আসেন এবং আকাবা নামক স্থানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে “প্রথম আকাবার সন্ধি” নামে পরিচিত। এই সন্ধিতে তারা প্রতিজ্ঞা করেন যে, তারা এক আল্লাহর উপাসনা করবেন, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন এবং সর্বদা সৎ পথে চলবেন। নবী (সা.) ইসলামের শিক্ষা ও প্রচার চালানোর জন্য মদিনায় মুসআব ইবনে উমায়র (রা.)-কে পাঠান। মুসআব (রা.) মদিনায় অত্যন্ত সুচারুভাবে দাওয়াত কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।

৪. দ্বিতীয় আকাবার সন্ধি

৬২২ খ্রিস্টাব্দে, পরবর্তী হজের মৌসুমে মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী মক্কায় এসে ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। এই সন্ধিকে “দ্বিতীয় আকাবার সন্ধি” বলা হয়। এই সন্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, তারা নবী (সা.) এবং অন্যান্য মুসলিমদের তাদের জীবনের সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং মদিনায় এসে আশ্রয় দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। এভাবে নবী (সা.) মদিনায় ইসলামের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি লাভ করেন।

৫. মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের ইসলাম গ্রহণের প্রভাব

আউস ও খাজরাজ গোত্রের ইসলাম গ্রহণ মদিনায় ইসলামের প্রচারকে আরও শক্তিশালী করে। এই গোত্রগুলোর মধ্যে ইসলাম শান্তি ও ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয়, এবং মদিনার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

৬. মদিনায় হিজরত ও ইসলামের নতুন অধ্যায়ের সূচনা

আউস ও খাজরাজের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য মদিনায় হিজরতের পথ সুগম হয়। মদিনার জনগণ নবী (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য এক নতুন আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রস্তুতি নেয়, যা ইসলামের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে। মক্কার প্রতিকূলতার কারণে নবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবীরা একে একে মদিনায় হিজরত করেন, এবং মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

মদিনায় ইসলামের বিকাশ ও শিক্ষা

মদিনায় হিজরতের পর মুসলিমরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী নীতি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান। আউস ও খাজরাজ গোত্রের সহযোগিতায় মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর মাধ্যমে শান্তি, ঐক্য ও সাম্যের পরিবেশ গড়ে ওঠে। ইসলাম এখানে দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাথমিক রূপও গড়ে ওঠে।

আকাবা সন্ধি এবং মদিনাবাসীর প্রতিজ্ঞা

প্রথম আকাবা সন্ধি (৬২১ খ্রিস্টাব্দ)

প্রথম আকাবা সন্ধি ছিল ইসলামের প্রচারের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের বারোজন প্রতিনিধি ৬২১ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় এসে আকাবা নামক স্থানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সন্ধিতে তারা ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং নিম্নলিখিত প্রতিশ্রুতি দেন:

  • তারা এক আল্লাহর উপাসনা করবেন এবং মূর্তি পূজা থেকে বিরত থাকবেন।
  • মিথ্যা বলা, চুরি করা, ব্যভিচার করা ইত্যাদি পাপ কাজ থেকে দূরে থাকবেন।
  • তারা মেয়েদের কন্যা সন্তান হত্যা করবেন না।
  • তারা ন্যায় ও সৎ পথে চলার চেষ্টা করবেন এবং আল্লাহর পথে প্রতিকূলতাকে সহ্য করবেন।

এই প্রথম আকাবা সন্ধির মাধ্যমে মদিনায় ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়। নবী (সা.) তাদের কাছে একজন দ্বীন শেখানোর জন্য মুসআব ইবনে উমায়র (রা.)-কে পাঠান, যিনি মদিনায় ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দ্বিতীয় আকাবা সন্ধি (৬২২ খ্রিস্টাব্দ)

পরবর্তী বছর, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, মদিনা থেকে আউস ও খাজরাজ গোত্রের ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী মক্কায় এসে পুনরায় আকাবা নামক স্থানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সন্ধিটি “দ্বিতীয় আকাবা সন্ধি” বা “আকাবার বাইআত” নামে পরিচিত।

এই দ্বিতীয় আকাবা সন্ধিতে মদিনাবাসী আরও বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা করেন:

  • তারা নবী (সা.)-কে তাদের নিজেদের আত্মীয় ও স্বজনের মতো সুরক্ষা প্রদান করবেন।
  • তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে, শান্তিকাল কিংবা যুদ্ধকালীন, নবী (সা.)-এর পাশে থাকবেন।
  • মদিনায় নবী (সা.)-কে এবং তাঁর সাহাবীদের আশ্রয় ও সমর্থন দেবেন, এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন।

মদিনাবাসীর প্রতিজ্ঞার গুরুত্ব

মদিনাবাসীর এই প্রতিজ্ঞা ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কারণ, এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমেই মদিনা মুসলমানদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি হয়। এভাবে মদিনায় ইসলামের প্রচার এবং প্রসার সহজতর হয়, এবং মুসলমানদের একটি সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত সমাজ গঠনের সুযোগ তৈরি হয়।

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি

দ্বিতীয় আকাবা সন্ধির পর, নবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পরিকল্পনা করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। মদিনায় ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি শাসনব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে ওঠে। নবী (সা.) মদিনায় একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল শান্তি, ন্যায় এবং সুষমতায় পূর্ণ।

কুরাইশদের চক্রান্ত এবং হত্যার পরিকল্পনা

মক্কায় ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও চক্রান্তের সম্মুখীন হন। যখন কুরাইশ নেতারা বুঝতে পারে যে ইসলামের প্রচার থামানো তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না এবং নবী (সা.)-এর বার্তা মক্কার সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা করে। অবশেষে, তারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার একটি চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র রচনা করে, যা ইসলামের ইতিহাসে “দারুন নাদওয়ার ষড়যন্ত্র” নামে পরিচিত।

কুরাইশদের চক্রান্ত ও হত্যার পরিকল্পনার কারণ

কুরাইশ নেতারা উপলব্ধি করেছিল যে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলামের দ্রুত প্রসার তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে কাবার মূর্তি পূজার উপর নির্ভরশীল তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। এছাড়া ইসলামের বার্তা তাদের সামাজিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, কারণ ইসলাম সাম্য ও ন্যায়ের কথা বলত, যা কুরাইশ নেতাদের নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

দারুন নাদওয়ার সভা ও চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র

৬২২ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ নেতারা “দারুন নাদওয়া” নামক একটি গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। এই বৈঠকে তারা নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করার জন্য একটি চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামকে ধ্বংস করা এবং মুসলিমদের নেতৃত্বহীন করে ফেলা। বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বিভিন্ন প্রস্তাব দেন, যেমন নবীকে বন্দী করা অথবা দেশ থেকে বিতাড়িত করা। তবে শেষপর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাঁকে হত্যা করাই সর্বোত্তম উপায়।

তবে তাঁকে হত্যার ক্ষেত্রে তারা আরও কৌশলী হয়ে ওঠে। তারা চেয়েছিল যে, মুহাম্মদ (সা.)-এর রক্তের প্রতিশোধ যেন তাদের কেউ না নিতে পারে। এজন্য তারা প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে শক্তিশালী তরুণকে নির্বাচন করে, যাতে সবাই মিলে একসাথে তাঁকে হত্যা করতে পারে। এতে মুহাম্মদ (সা.)-এর গোত্র বনু হাশিম কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে সাহস পাবে না, কারণ এতে গোত্রীয় রক্তপাতের সম্ভাবনা তৈরি হতো এবং বনু হাশিম গোত্রের জন্য এতগুলো গোত্রের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব হয়ে পড়ত।

আল্লাহর পরিকল্পনা এবং নবী (সা.)-এর রক্ষা

কুরাইশদের এই চক্রান্তের কথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেন এবং তাঁকে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। এর ফলে নবী (সা.) একটি পরিকল্পনা করেন। তিনি আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে নিজের বিছানায় শুতে বলেন, যাতে কুরাইশরা মনে করে তিনি (সা.) এখনও ঘুমিয়ে আছেন। আলী (রা.) সাহসিকতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন, এবং কুরাইশদের চোখে ধুলো দিয়ে নবী (সা.) তাঁর বন্ধু আবু বকর (রা.)-কে সাথে নিয়ে মদিনার পথে পাড়ি জমান।

সুরা আল-আনফাল এবং ষড়যন্ত্রের উল্লেখ

এই ঘটনাটি কুরআনের সুরা আল-আনফাল-এর ৩০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে:

“আর যখন কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, তোমাকে বন্দী করার, হত্যা করার অথবা বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করছিল, তখন তারাও পরিকল্পনা করছিল, এবং আল্লাহও পরিকল্পনা করছিলেন। আর আল্লাহ সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।” (সুরা আল-আনফাল, আয়াত ৩০)

হিজরত এবং ইসলামের জন্য নতুন অধ্যায়ের সূচনা

কুরাইশদের হত্যার ষড়যন্ত্রের ফলে নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। মদিনায় ইসলামের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নবী (সা.) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে।

হিজরতের পথে থোর গুহায় আত্মগোপন

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের সময় মক্কার কুরাইশ নেতারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। আল্লাহর নির্দেশে নবী (সা.) মদিনায় হিজরতের প্রস্তুতি নেন এবং তাঁর বন্ধু আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। হিজরতের সময় তাদের পেছনে কুরাইশদের অনুসন্ধান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর বিশেষ পরিকল্পনায় তাঁরা মক্কার থোর পাহাড়ে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এই থোর গুহায় আত্মগোপন ছিল হিজরতের পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।

থোর গুহায় আত্মগোপন

নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং আবু বকর (রা.) যখন মক্কা ত্যাগ করেন, তখন কুরাইশরা তাঁদের খুঁজতে বিভিন্ন দিক থেকে অনুসন্ধান শুরু করে। তাঁরা চেয়েছিল নবী (সা.)-কে যে কোনো মূল্যে ধরে ফেলতে। মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার প্রধান রাস্তাটি তারা নজরে রাখছিল, তাই নবী (সা.) এবং আবু বকর (রা.) সরাসরি মদিনার পথে না গিয়ে প্রথমে মক্কার কাছাকাছি থোর পাহাড়ে অবস্থিত একটি গুহায় আত্মগোপন করেন। তাঁরা সেখানে তিন দিন অবস্থান করেন, যাতে কুরাইশদের অনুসন্ধান ঠাণ্ডা হয়ে আসে এবং তারা নিরাপদে মদিনার পথে এগোতে পারেন।

গুহার অলৌকিক ঘটনা

থোর গুহায় অবস্থানের সময় একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে, যা কুরাইশদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়। আল্লাহর হুকুমে একটি মাকড়সা গুহার মুখে জাল বুনে দেয় এবং দুটি বুনো কবুতর এসে গুহার সামনে বাসা বাঁধে ও ডিম পাড়ে। এর ফলে, যখন কুরাইশদের অনুসন্ধানকারী দল গুহার সামনে এসে দেখে যে মাকড়সার জাল অক্ষত রয়েছে এবং কবুতর বাসা বেঁধে ডিম পেড়েছে, তখন তারা ধারণা করে যে কেউ এতদিন গুহায় প্রবেশ করেনি। তাই তারা সেখান থেকে ফিরে যায় এবং নবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) নিরাপদে রক্ষা পান।

আবু বকর (রা.)-এর উদ্বেগ এবং নবী (সা.)-এর সাহস

থোর গুহায় অবস্থানের সময় আবু বকর (রা.) খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ কুরাইশদের দলের সদস্যরা গুহার কাছাকাছি চলে এসেছিল। তিনি নবী (সা.)-কে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! যদি তারা নিচের দিকে তাকায়, তবে আমাদের দেখতে পাবে।” এই সময় নবী (সা.) তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং বলেন:

“লা তাহজন ইন্নাল্লা-হা মা’আনা” – অর্থাৎ “ভয় পেও না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৪০)

এই আয়াতটি নবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থার প্রতীক। তাঁর এই আত্মবিশ্বাস আবু বকর (রা.)-এর মনোবল শক্তিশালী করে এবং আল্লাহর প্রতি তাঁদের নির্ভরশীলতা আরও দৃঢ় করে।

মদিনায় গমন

থোর গুহায় তিন দিন অবস্থান করার পর, কুরাইশদের অনুসন্ধান যখন শিথিল হয়, তখন নবী (সা.) এবং আবু বকর (রা.) গাইড হিসেবে আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিতের সাহায্যে মদিনার দিকে যাত্রা করেন। এভাবে তাঁরা আল্লাহর পরিকল্পনার মাধ্যমে কুরাইশদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে সফলভাবে মদিনায় পৌঁছান।

দীর্ঘ পথযাত্রা এবং মদিনায় আগমন

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরত ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই হিজরত ছিল দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রা, তবে এটি ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। মদিনায় আগমন ইসলামের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যেখানে মুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় জীবন চর্চা এবং স্বাধীনভাবে সমাজ গঠনের সুযোগ পায়।

১. দীর্ঘ পথযাত্রা

থোর গুহায় তিন দিন আত্মগোপন করার পর নবী (সা.) এবং আবু বকর (রা.) মদিনার পথে যাত্রা করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিত নামে একজন দক্ষ গাইড তাঁদেরকে মদিনার পথ দেখাতে সাহায্য করেন। পথটি ছিল কঠিন, অপ্রশস্ত, এবং নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে যেতে হয়েছিল।

এই দীর্ঘ যাত্রায় তাঁরা দিনের বেলায় বিশ্রাম নিতেন এবং রাতের অন্ধকারে চলতেন, যাতে কুরাইশদের অনুসন্ধান থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আবু বকর (রা.) অনেক সময় নবী (সা.)-এর সামনে এবং কখনও তাঁর পাশে চলতেন, যাতে বিপদ এলে প্রথমে তিনি তা সামলাতে পারেন। এই যাত্রায় তাঁদের জন্য রসদ ও পানির ব্যবস্থা করেছিলেন আবু বকর (রা.)-এর কন্যা আসমা (রা.)।

২. বিভিন্ন স্থানে বিরতি

হিজরতের পথে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে বিরতি নেন এবং লোকজনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই যাত্রাপথে তাঁরা ইসলামের বাণীও পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই সময়ে যেসব স্থান দিয়ে তাঁরা অতিক্রম করেছিলেন, সেখানে ইসলামের বার্তা ধীরে ধীরে পৌঁছাতে শুরু করে এবং এই স্থানের মানুষদের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

৩. সুরাকাহ ইবনে মালিকের ঘটনা

এই দীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁদের বিপদের মধ্যে অন্যতম ছিল সুরাকাহ ইবনে মালিকের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। কুরাইশরা নবী (সা.) এবং আবু বকর (রা.)-কে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারলে বড় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। সুরাকাহ ইবনে মালিক এই পুরস্কারের লোভে তাঁদের সন্ধানে বের হন এবং তাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে যান। তবে যখন তিনি নবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, তখন আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর ঘোড়ার পা বারবার মাটিতে আটকে যায়, এবং তিনি মাটিতে পড়ে যান। এই অলৌকিক ঘটনার প্রভাব সুরাকাহর ওপর এমনভাবে পড়ে যে, তিনি ইসলাম সম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবী (সা.)-এর মদিনায় আগমন পর্যন্ত নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেন।

৪. কুবা নামক স্থানে আগমন

মদিনার বাইরে অবস্থিত কুবা নামক স্থানে নবী (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা হিজরতের যাত্রা শেষে প্রথমে আসেন। সেখানে তিনি চার দিন অবস্থান করেন এবং এই সময়ে মদিনার অনেক মুসলমান তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। এখানে নবী (সা.) মুসলমানদের জন্য প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ হিসেবে পরিচিত এবং কুবা মসজিদ নামে পরিচিত।

৫. মদিনায় আগমন

চার দিন পর নবী (সা.) মদিনার পথে আবার যাত্রা করেন। মদিনার লোকজনের মধ্যে তাঁর জন্য উৎসাহ এবং ভালোবাসার অন্ত ছিল না। তাঁরা মদিনার বাইরে গিয়ে নবী (সা.)-কে স্বাগত জানান এবং আনন্দের সাথে তাঁকে মদিনায় গ্রহণ করেন। তাঁর আগমনের সময় তাঁরা গান ও কবিতার মাধ্যমে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।

৬. মদিনায় ইসলামের নতুন অধ্যায়ের সূচনা

মদিনায় আগমনের পর নবী (সা.) মুসলমানদের জন্য একটি শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ সমাজ গঠনের কাজ শুরু করেন। তিনি মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা শান্তি, সাম্য, এবং ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনি মদিনার মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য গোত্রের মাঝে একটি চুক্তি করেন, যা “মদিনার সনদ” নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে মদিনায় একটি শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠন করা হয়েছিল।

ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং মদিনার মসজিদ নির্মাণ

মদিনায় হিজরতের পর নবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা শান্তি, ন্যায়বিচার, এবং সামাজিক ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল। এই রাষ্ট্রের মূল কেন্দ্র ছিল নবী (সা.) কর্তৃক নির্মিত মসজিদে নববী, যা শুধু প্রার্থনার স্থানই ছিল না, বরং ইসলামের প্রথম প্রশাসনিক ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল। এটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে।

ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

মদিনায় হিজরতের পর নবী (সা.) বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। মদিনায় ইহুদি, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য গোত্রের মানুষও বাস করত, এবং এইসব গোত্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। নবী (সা.) এই শহরের মানুষকে একত্রিত করে একটি সংহত সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে “মদিনার সনদ” নামে পরিচিত একটি চুক্তি করেন।

মদিনার সনদ

মদিনার সনদ ছিল ইসলামের প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সনদের মাধ্যমে মদিনার সব সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সনদের প্রধান পয়েন্টগুলো ছিল:

  1. ধর্মীয় স্বাধীনতা: প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারবে এবং অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
  2. পারস্পরিক সহায়তা: কোনো বহিরাগত আক্রমণের ক্ষেত্রে সব সম্প্রদায় মিলিতভাবে আত্মরক্ষা করবে।
  3. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি সংহত বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।
  4. পারস্পরিক সম্পর্ক: সবাই একে অপরের সহায়ক হবে এবং অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে না।

মদিনার সনদ দ্বারা নবী মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র মদিনার জনগণকে একটি সংহত রাষ্ট্রে পরিণত করেন, যা পরবর্তীতে ইসলামের শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে ওঠে।

মসজিদে নববী নির্মাণ

মদিনায় আগমনের পর নবী (সা.) প্রথমেই একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, কারণ এটি হবে ইসলামের মূল কেন্দ্র, যেখানে মানুষ নামাজ আদায় করবে, শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং সামরিক ও সামাজিক বিষয়েও আলোচনা হবে।

মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া

নবী (সা.) প্রথমে মদিনায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিজ উটটি ছেড়ে দেন এবং যেখানে উট বসে যায়, সেখানেই মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্ধারিত হয়। পরে এই জমিটি দুজন এতিম শিশুর কাছ থেকে ক্রয় করে মসজিদ নির্মাণ শুরু করা হয়। মসজিদের নির্মাণকাজে নবী (সা.) নিজে শ্রমিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন এবং সাহাবীগণও তাঁকে সহায়তা করেন।

মসজিদে নববীর বৈশিষ্ট্য

  • প্রথম কাঠামো: মসজিদটি খুবই সাধারণভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এটি ছিল মাটির তৈরি দেয়াল এবং ছাদটি খেজুরের পাতা দিয়ে আচ্ছাদিত। ফ্লোরও মাটির ছিল, যেখানে নামাজ আদায় করা হতো।
  • আকর্ষণীয় অংশ: মসজিদের একটি অংশকে “সুফফা” বলা হতো, যেখানে আশ্রয়হীন এবং শিক্ষা গ্রহণকারী সাহাবীগণ অবস্থান করতেন। এখানেই তাঁরা ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং মসজিদের এই অংশটি ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।

মসজিদে নববী: ইসলামি কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা

মসজিদে নববী শুধুমাত্র নামাজ আদায়ের স্থান ছিল না; এটি ছিল ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল। মসজিদ থেকে ইসলামের বিভিন্ন বিধান প্রচার করা হতো এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল:

  1. প্রার্থনার স্থান: মসজিদে নববী নামাজ আদায়ের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই মসজিদে নামাজের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল।

  2. শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা: সুফফা ছিল জ্ঞান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে নবী (সা.) ইসলামী শিক্ষা প্রদান করতেন এবং সাহাবীগণ কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা লাভ করতেন। এটি ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল।

  3. সামাজিক ও বিচারকার্য কেন্দ্র: মসজিদে নববীতে বিভিন্ন বিচারকার্য সম্পন্ন করা হতো এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। এটি ছিল ইসলামের প্রথম আদালত, যেখানে বিভিন্ন বিচারকার্য সম্পন্ন করা হতো।

  4. সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা: মসজিদে নববী থেকেই বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো এবং মুসলিমদের রণনীতি পরিকল্পনা করা হতো।

হিজরতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

হিজরত কেবল স্থানান্তর ছিল না; এটি ইসলামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইসলামের খিলাফতের সূত্রপাত হয়। হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও বিশ্বাস বাড়ে এবং ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাসুল (সা.) এর হিজরতের শিক্ষা এবং বর্তমান সমাজে প্রাসঙ্গিকতা

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরত কেবল অতীতের একটি ঘটনা নয়, এটি বর্তমান সমাজে শিক্ষণীয় একটি অধ্যায়। এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা ত্যাগ, ধৈর্য, সাহসিকতা এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থার শিক্ষা পাই। বর্তমান সময়ে মুসলমানদের হিজরতের তাৎপর্য বুঝে তাদের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটানো উচিত।


উপসংহার

হিজরত ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাসুল (সা.)-এর হিজরতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর পথে ত্যাগ, সহ্যশক্তি ও ইমানের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি। এটি আমাদের জীবনে এমনভাবে প্রভাব ফেলেছে যা আজও মুসলিমদের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *