ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা সাধারণত রমজান মাসে মসজিদে থেকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। এটি ইসলামিক সংস্কৃতির একটি পবিত্র আচার যেখানে মুমিন মুসলমান নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দুনিয়ার কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করেন। এ লেখায় আমরা ইতিকাফের বিধান, নিয়ম-কানুন এবং হাদিসের আলোকে ইতিকাফ পালনের সকল দিক বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবো।
ইতিকাফের সংজ্ঞা
ইতিকাফ শব্দটি আরবি ভাষার ‘আকফ’ মূল থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা বা একাগ্রচিত্তে অবস্থান করা। ইসলামের পরিভাষায়, ইতিকাফ বলতে বুঝায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট সময় মসজিদে একাগ্রতার সাথে অবস্থান করা। এটি রমজানের শেষ দশকে করা সুন্নত।
ইতিকাফের গুরুত্ব ও মর্যাদা
ইতিকাফ এমন একটি ইবাদত যা রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জীবনে গুরুত্বসহকারে পালন করেছেন এবং মুসলিমদের প্রতি এটি পালনের জন্য উৎসাহিত করেছেন। রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনের শেষ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পালন করতেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইতিকাফ পালন করে, সে ব্যক্তি এত পরিমাণ সাওয়াব অর্জন করে যা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের উন্নতি সাধন করতে সহায়তা করে।”
ইতিকাফের বিধান
ইতিকাফ পালনের বিধান সাধারণত সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ওয়াজিব বা নফল হতে পারে।
১. সুন্নত ইতিকাফ: রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নত মুআক্কাদা হিসেবে পালিত হয়। এটি রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবীরা নিয়মিতভাবে পালন করেছেন।
২. ওয়াজিব ইতিকাফ: কোনো মানত বা প্রতিজ্ঞা করলে সে অনুযায়ী ইতিকাফ পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। যেমন কেউ কোনো বিশেষ সমস্যা থেকে মুক্তি পেলে ইতিকাফ পালন করবেন বলে মানত করেন।
৩. নফল ইতিকাফ: কোনো নির্দিষ্ট সময় বা বিশেষ মানতের প্রয়োজন ছাড়াই মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে অবস্থান করলে সেটি নফল ইতিকাফ বলে গণ্য হয়।
ইতিকাফে বসার নিয়ম-কানুন
১. নিয়তের গুরুত্ব
ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য একাগ্রভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিয়ত করা জরুরি। নিয়ত কেবল হৃদয়ের বিষয় এবং মুখে উচ্চারণ করাও সম্ভব, তবে সেটি অবশ্য নয়। নিয়ত একান্তই আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত।
২. মসজিদে অবস্থান করা
ইতিকাফ করার জন্য মসজিদে অবস্থান করা আবশ্যক। বাড়িতে ইতিকাফ করা ইসলামের বিধান অনুযায়ী শুদ্ধ নয়, তবে নারীদের ক্ষেত্রে বাড়ির একটি নির্দিষ্ট ঘরকে মসজিদের মতো ব্যবহার করে ইতিকাফ করা যায়।
৩. ইতিকাফের সময়কাল
রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ পালন করা সুন্নত, যা সাধারণত ২০ রমজান সন্ধ্যায় শুরু হয় এবং ঈদের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে ইতিকাফ নফল হলে যেকোনো সময়, যতদিন ইচ্ছা, মসজিদে অবস্থান করতে পারেন।
৪. ইবাদতে মনোযোগী থাকা
ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য হলো ইবাদতে মনোযোগী থাকা। তাই এই সময় কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইস্তিগফার, নফল নামাজ আদায় এবং দ্বীনের জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ করা উচিত।
ইতিকাফে বসার শুদ্ধ নিয়ম-কানুন
১. মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা
ইতিকাফের সময়কাল কাটানো উচিত আল্লাহর স্মরণে এবং তাঁকে বেশি করে ইবাদতে। কুরআন তিলাওয়াত, যিকর, দোয়া এবং ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করতে হবে।
২. অপ্রয়োজনীয় কথা-বার্তা পরিহার করা
ইতিকাফ পালনের সময় অপ্রয়োজনীয় কথা-বার্তা, হাসি-ঠাট্টা এবং পার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা পরিত্যাজ্য। ইতিকাফকারীকে যতটা সম্ভব ইবাদতে এবং চিন্তায় আল্লাহর স্মরণে মনোনিবেশ করতে হবে।
৩. মুসল্লির অধিকার রক্ষা করা
ইতিকাফে থাকা অবস্থায় মসজিদে থাকা অন্যান্য মুসল্লিদের যাতে কোনোভাবে বিরক্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইবাদতের সময় অন্য মুসল্লিদের মনোযোগে ব্যাঘাত না ঘটানোই মূল লক্ষ্য।
ইতিকাফের কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিস
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা ইতিকাফের গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরে:
১. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন।” (বুখারি, মুসলিম)
২. আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) শেষ দশক ইতিকাফ করতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তায়ালার কাছে পৌঁছেছিলেন।” (বুখারি, মুসলিম)
৩. হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ইতিকাফকারী ব্যক্তি সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে এবং তার জন্য সে সমস্ত সাওয়াব লিখে রাখা হয় যা একজন ইবাদতরত মুমিনের জন্য বরাদ্দ থাকে।” (ইবনে মাজাহ)
ইতিকাফের সহীহ আমল ও দোয়া
ইতিকাফে অবস্থানকারী ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নিম্নলিখিত আমল ও দোয়া করতে পারেন:
১. কুরআন তিলাওয়াত: ইতিকাফে বেশি পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।
২. দোয়া ও ইস্তিগফার: অধিক পরিমাণে দোয়া এবং ইস্তিগফার করা উচিত। কিছু বিশেষ দোয়া হচ্ছে:
- اللهم إنك عفو كريم تحب العفو فاعف عني (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নী): অর্থাৎ, “হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসো, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করো।”
৩. নফল নামাজ: ইতিকাফের সময় বেশী পরিমাণে নফল নামাজ আদায় করতে পারেন। বিশেষত তাহাজ্জুদ, ইশরাক ও চাশতের নামাজ পড়ার চেষ্টা করা উচিত।
৪. সালাতুত তাসবিহ: এই নামাজ বিশেষ দোয়া এবং তাসবিহর মাধ্যমে ইবাদতকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য একটি পদ্ধতি।
নারীদের জন্য ইতিকাফের নিয়ম
নারীরা বাড়িতে ইতিকাফ করতে পারেন। বাড়ির একটি নির্দিষ্ট ঘর মসজিদ হিসেবে নির্ধারণ করে সেখানে অবস্থান করবেন। তবে, বাড়ির কাজের বাধা এড়াতে তাদের জন্য ইতিকাফ পালনের সময় সংসারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি থাকা জরুরি। নারীরা ইতিকাফের সময় যতটা সম্ভব বেশি ইবাদতে এবং আল্লাহর স্মরণে সময় কাটাবেন।
ইতিকাফ ভঙ্গের কারণসমূহ
ইতিকাফের নিয়ম মেনে না চললে বা কোন কারণবশত ইতিকাফ ছেড়ে দিলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়। ইতিকাফ ভঙ্গের কারণসমূহ হলো:
১. মসজিদ থেকে বের হওয়া: ইতিকাফকারী যদি কোনো শারীরিক বা ধর্মীয় কারণ ছাড়া মসজিদ থেকে বের হন, তাহলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
২. পাপ কাজ করা: ইতিকাফে থাকা অবস্থায় কোনো বড় ধরনের পাপ কাজ করা যেমন—মিথ্যা বলা, পরনিন্দা করা, লোভ লালসায় লিপ্ত হওয়া, ইত্যাদি।
৩. জরুরি কারণে বের হওয়া: যেমন কোনো গুরুতর অসুস্থতা বা মূত্রত্যাগ, পায়খানা বা ওযু করার প্রয়োজন হলে মসজিদ থেকে বের হওয়া যায়, তবে দ্রুত ফিরে আসা জরুরি।
ইতিকাফের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন ও রাত
ইতিকাফের সময়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি লাইলাতুল কদরের সন্ধানের সময়। আল্লাহ তাআলা রমজানের শেষ দশ দিনে এমন একটি রাত রেখেছেন, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
উপসংহার
ইতিকাফ ইসলামের একটি বিশেষ ইবাদত যা মুমিনের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এই ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা অর্জন করতে পারে। সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে ইতিকাফ পালন করলে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ লাভ করবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই ইবাদতের তৌফিক দান করুন এবং আমাদের ইতিকাফ কবুল করুন। আমিন।