ভূমিকা:
যাকাত হলো ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা মুসলিম সমাজে ধনী ও গরীবের মধ্যে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করে। ইসলাম ধর্মে যাকাত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গরিবদের প্রতি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয়। আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত সম্পদের নির্দিষ্ট একটি অংশ যাকাত হিসেবে প্রদান করতে হয়।
যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যাকাত শব্দটি আরবি “যাকাতুন” শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ পবিত্রতা, বৃদ্ধি এবং কল্যাণ। কুরআনে এবং হাদিসে যাকাত প্রদানকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,
“আর তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ৪৩)
যাকাত আদায়ের কারণ ও উদ্দেশ্য
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদের পবিত্রতা ও বৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে মানবসেবার সুযোগ তৈরি হয় এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও যাকাত বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইসলামে যাকাত আদায়ের কারণে ধনী এবং দরিদ্রদের মাঝে একটি সুন্দর ভারসাম্য সৃষ্টি হয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসে।
যাকাতের বিধান ও কুরআনের নির্দেশনা
ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের একটি হিসেবে যাকাতকে কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন:
“তাদের সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।” (সূরা আয্-যারিয়াত, আয়াত: ১৯)
এছাড়াও মহান আল্লাহ কুরআনে যাকাতকে নামাজের সাথে সম্পর্কিত করে উল্লেখ করেছেন। যেমন,
“যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত আদায় করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।” (সূরা আনফাল, আয়াত: ৩)
যাকাতের হাদিসসমূহ
নবী করীম (সাঃ) যাকাত প্রদানের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন,
“যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় যাকাত আদায় করে, তার জন্য আল্লাহ্ তায়ালা জান্নাতে ৮টি দরজা খুলে দেবেন এবং সে যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী)
এছাড়াও নবীজী (সাঃ) বলেছেন,
“যে সম্পদের যাকাত আদায় করা হয় না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ সাপ হয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
যাকাতের বিধান ও ইসলামী আইন
যাকাত ইসলামী আইন অনুযায়ী একটি বাধ্যতামূলক ইবাদত। সাধারণত যেসব ব্যক্তির কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং এক বছর ধরে সেই সম্পদ নির্দিষ্ট নেসাব অতিক্রম করে, তারাই যাকাত আদায়ের জন্য দায়বদ্ধ হন। ইসলামের দৃষ্টিতে নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করলে যাকাত আদায় করা বাধ্যতামূলক হয়:
১. সম্পদের মালিকানা: সম্পদ যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে, তার জন্য যাকাত আদায় করা আবশ্যক।
২. পূর্ণ এক বছর সম্পদের স্থিতি: যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে স্থিতিশীল থাকতে হবে।
৩. নেসাব পরিমাণ সম্পদ: ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ (নেসাব) হতে হবে, যা স্বর্ণ বা রৌপ্যের মূল্যে নির্ধারিত।
যাকাতের প্রকারভেদ
যাকাতকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যেতে পারে:
১. স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত: ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের নেসাব অতিক্রম করলে যাকাত দিতে হবে।
২. ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়িক সম্পদের উপরে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হয়।
৩. অর্থ ও নগদের যাকাত: ব্যাংক সঞ্চয় ও নগদ অর্থের উপরও ২.৫% হারে যাকাত আদায় করতে হবে।
৪. কৃষি ও পশুপাখির যাকাত: কৃষিজ সম্পদ এবং গবাদি পশুর উপরও যাকাত নির্ধারিত আছে।
যাকাত প্রদানের পদ্ধতি
ইসলামে যাকাত প্রদান একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে করতে হয়। সাধারণত নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের জন্য যাকাত প্রদান করা হয়ে থাকে:
১. গরিব ও মিসকিন: যাদের কাছে যাকাত দেওয়া হবে, তাদের মধ্যে গরিব এবং মিসকিন অন্যতম।
২. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত এবং ঋণ পরিশোধে সক্ষম নয়, তাকেও যাকাত প্রদান করা যায়।
৩. ইসলাম গ্রহণকারী: নব-মুসলিমদেরকে যাকাত প্রদান করা তাদের সাহায্য করতে পারে।
৪. পর্যটক ও মুসাফির: দীর্ঘ পথযাত্রায় আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাদের যাকাত দেওয়া যায়।
যাকাত প্রদানের শর্ত
যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। যেমন:
১. ইখলাস বা একান্ত নির্ভরতা: যাকাত প্রদান করতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
২. নিয়ত: যাকাত প্রদানের পূর্বে নিয়ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. গোপনীয়তা: যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখা উত্তম। প্রকাশ্যে দেওয়ার চেয়ে গোপনে দেওয়া সওয়াবের দিক থেকে উত্তম বলে গণ্য করা হয়।
যাকাত প্রদান না করলে শাস্তি
ইসলামে যাকাত প্রদান না করা একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর শাস্তি সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেন,
“যে ব্যক্তি নিজের সম্পদের যাকাত আদায় করবে না, তার সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে কিয়ামতের দিন তার গায়ে লাগানো হবে।” (বুখারী)
এছাড়াও আল্লাহ বলেন,
“আর যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা তওবা, আয়াত: ৩৪)
উপসংহার
যাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান এবং মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি অপরিহার্য ইবাদত। যাকাত প্রদান করলে সম্পদের পবিত্রতা বজায় থাকে এবং মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনেও তা বিশেষ ভূমিকা রাখে।